সংস্কার, নির্বাচন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ধরে রাখার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারবিষয়ক কমিটিগুলোর সংস্কার প্রস্তাবের ওপর নজর রাখছেন। কমিটিগুলো যেসব প্রস্তাব দিচ্ছে, তাতে যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে উঠবে তা সরকার কার্যকর করবে বলেও তাদের আশা।
নেতারা বলেন, বিগত সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে যেসব রাজনৈতিক দল ছিল তাদের ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন তারা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যচেষ্টা প্রায়ই বাধাগ্রস্ত হচ্ছে; আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধানের চেষ্টা চলছে। দলীয়ভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তারা।
বিএনপির নেতারা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিল। তারা এককভাবে এটি করলে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারত। বিএনপি সে বিশৃঙ্খলা থেকে দেশকে রক্ষা করেছে; অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এগিয়ে এসেছিলেন।
সংস্কার, নির্বাচন ও রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রেখে কীভাবে এগোচ্ছে বিএনপি, জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে সংস্কার, নির্বাচন ও ঐক্য ধরে রাখাসহ নানামুখী কাজ করছে। এসব কিছুর নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এজন্য বিভিন্ন কমিটি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের কমিটিগুলোর প্রধান করা হয়েছে। দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম ও নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে আলাদা কমিটি রয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখতে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু নিয়মিত বৈঠক করছেন।’
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দিনাজপুরে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধে ছিলাম। গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধেও ছিলাম। গণতান্ত্রিক যুদ্ধ শেষ হয়েছে। কিন্তু এখন ঐক্য রক্ষার যে যুদ্ধ, তাতে আমাদের ব্যর্থতা আছে।’
রাজনৈতিক ঐক্য গড়ায় ব্যর্থতার বিষয়ে বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির এক ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টা রয়েছে। সমস্যা হলে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে ঐক্য ধরে রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এসব বিষয়ে নির্দেশনা দেন। আলাপ-আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা গত ৩১ ডিসেম্বর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। তারা বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু বিএনপি তাদের এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হতে অপারগতা প্রকাশ করে। কারণ বিএনপি মনে করেছে, এ জাতীয় ঘোষণা দিলে দেশে অরাজকতা তৈরি হতে পারে। এ জাতীয় ঘোষণাপত্র একমাত্র সরকারই করতে পারে। এজন্য বিএনপি মহাসচিব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করার জন্য সরকারকে অনুরোধ করা হয়। পরে সরকারের দিক থেকে বক্তব্য প্রকাশের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা থেকে পিছু হটে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘সংস্কার ও রাজনৈতিক ঐক্য ধরে রাখার মাধ্যমে দেশকে নির্বাচনমুখী করার কাজ বিএনপি করে যাচ্ছে। যারা নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। সংস্কার সবাই চায়। কিন্তু সংস্কার হতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে। সরকার দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে এটাই জনগণের আশা।’
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করতে একাধিক কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিগুলোর কাজ সমন্বয় করতে রাষ্ট্র সংস্কার নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এর প্রধান করা হয় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাউদ্দিন আহমেদ এবং সাবেক সচিব ইসমাইল জবিউল্লাহকে রাখা হয়েছে এ কমিটিতে।
পাবলিক সার্ভিস কমিশন সংস্কারবিষয়ক কমিটিতে রাখা হয়েছে সালাউদ্দিন আহমেদ, ইসমাইল জবিউল্লাহ ও সাবেক আমলা বিজন কান্তি সরকারকে। প্রশাসন সংস্কার নিয়ে একই কমিটি কাজ করবে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য কমিটিতে স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনকে প্রধান করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিটিতে আছেন নজরুল ইসলাম খান ও সালাউদ্দিন আহমেদ। এ কমিটিতে নির্বাচন কমিশনের সাবেক একজন কর্মকর্তাও থাকবেন। ব্যাংকিং ও বাণিজ্য কমিটিতে আছেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও আব্দুল আউয়াল মিন্টু। বিচার বিভাগের সংস্কার কমিটির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারকে। পুলিশ সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদকে।
গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কার করার পদক্ষেপ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত জানান। ছয়জন বিশিষ্ট নাগরিককে কমিশনগুলো পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
বিএনপি গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পুলিশ সংস্কারে আমরা যেসব প্রস্তাব তৈরি করেছিলাম তা সংশ্লিষ্ট কমিশনের কাছে জমা দিয়েছি। অন্য কমিটিগুলো তাদের প্রস্তাব সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর কাছে জমা দিয়েছে।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর
বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন